ইন্টারনেটের গুরুত্ব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা
ইন্টারনেট ভাঙার দ্বার খুলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে তথ্যের প্রবাহের জন্য। আজকের যুগে, একটি কুচ্ছিত সংবাদ বা এমনকি একটি ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে, সোशल মিডিয়া একটি অত্যন্ত কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে হাজির হচ্ছে, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং তথ্যের আদান প্রদানকে সহজ করে তোলে। এটি ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলন এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রাম, মানুষের মধ্যে যোগাযোগের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখানে বোঝা দরকার, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া জনগণের অভিজ্ঞান এবং মতামতগুলোকে একটি বৃহৎ পরিসরে প্রচার করে এবং কিভাবে এটি বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে একত্রিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।
সংবাদ মাধ্যমের এই নতুন রূপ জনগণের নিকটবর্তী অবস্থান তৈরি করে এবং তাদের অধিকারে সচেতন করে তোলে। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সমন্নয়ও সৃষ্টি করে, যার ফলে তথ্যসমূহ স্বচ্ছতা ও সহজে বিতরণ করতে সহায়ক হয়। বিশেষ করে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসংগে, সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। জনগণের নিকট তথ্য দ্রুত ফলো আপ করা সম্ভব হয়, যা একটি যন্ত্রের মতো কাজ করে, একত্রিতভূমিতে বিক্ষোভ কিংবা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করে।
এভাবে, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং নাগরিকদের মধ্যে তথ্য আর প্রচারণার প্রবাহ নিশ্চিত করে। এতে রাজনৈতিক সম্বোধন, সামাজিক সমস্যা এবং সমষ্টিগত আন্দোলনগুলো আরো সহজ হয়ে ওঠে। তাই, সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম এবং এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাহসী নাগরিকতার উন্নয়নে অপরিহার্য।
বিক্ষোভ দমনে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
সম্প্রতি বিক্ষোভ দমন করার জন্য অনেক সরকার ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সীমিত করে এসেছে। এই পদক্ষেপগুলো সাধারণত বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করে তাদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য নেওয়া হয়। অতীতে, যেমনটি দেখা গেছে, সেনেগাল ও ইজিপ্টের মতো দেশগুলোতে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখলে সাময়িকভাবে বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই কৌশলগুলি কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। বিভিন্ন গবেষণা এই বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে নির্দেশিত করে যে নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘকালীন সমাধান নয় এবং তা জনসাধারণের অসন্তোষকে আরও প্রকট করতে পারে।
এছাড়া, প্রশাসনের পক্ষে এই কৌশলটির সুবিধা হলো বিক্ষোভের চলমানতা কমিয়ে আনা, যা উদ্বেগের মধ্যে থাকে। বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা মানুষকে সহানুভূতির শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এবং আন্দোলনকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। তাই ইন্টারনেটের নিষেধাজ্ঞা কর্তৃপক্ষকে কিছুটা সুবিধা দিলেও, এটি সাধারণ জনগণের প্রতি হতাশার জন্ম দেয় এবং সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে।
অন্যদিকে, এমন নিষেধাজ্ঞার ফলে সরকারগুলোর প্রতি জনগণের মধ্যে সন্দেহ এবং প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইরানে ২০১৯ সালে ইন্টারনেট সতর্কতার মাধ্যমে দোকানদার গুলি করে এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার সঙ্গে মোকাবিলা করা করেছিলেন, তা মাত্রাতিরিক্ত মাত্রায় সাফল্য এনে দেয়নি।
এভাবে, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে বিক্ষোভ দমন করার প্রচেষ্টা কিছুটা কার্যকর মনে হলেও, এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল আসলে ভিন্ন হতে পারে, যা প্রমাণ করে যে শুধু প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সামাজিক ধাক্কা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
গত কিছুবছরে যেসব দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে
গত কয়েক বছরে, বিভিন্ন দেশের সরকার রাজনৈতিক অস্থিরতা দমন করার উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এই ধরনের পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা এবং জনগণের যোগাযোগের মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে দেখা যায়, এই পদক্ষেপগুলি ফলপ্রসূ হয় কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে ইরানে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল যখন সরকারী নীতির বিরুদ্ধে জনতার বিক্ষোভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উত্তরোत्तर চাপ এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও, ইন্টারনেট ব্লকের ফলে সরকার কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পেরেছিল। তবুও, এসব পদক্ষেপের ফলে জনগণের মধ্যে আরও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, যা পরবর্তীতে কোনো পরিস্থিতিতে প্রচারকদের চূড়ান্ত ঘটনায় রূপান্তরিত হতে পারে।
অন্যদিকে, ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, সরকার ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং বিভিন্ন কোনো ধরনের যোগাযোগকে ভাষা অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এলাকায় অস্থিরতা শূন্য করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তবুও মনোভাব পরিবর্তনে এ পদক্ষেপের ভূমিকা সীমিত ছিল। জনগণ নতুন নতুন পরিকল্পনা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করে প্রতিবাদের মধ্যে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছিল।
এছাড়া, বিভিন্ন আফ্রিকান দেশে, যেমন সুদান এবং ইথিওপিয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করার উদাহরণ রয়েছে। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমেও সরকার জনসমর্থন কমাতে পারেনি। বরং, এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার প্রচেষ্টা জনতার প্রতিবাদকে দমন করতে সফল হয় না।
বিক্ষোভের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির নতুন ব্যবহার
বর্তমানে বিক্ষোভ এবং আন্দোলন পরিচালনায় নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার একটি বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যদিও প্রশাসন এবং সরকারী কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করে, বিক্ষোভকারীরা তাদের বক্তব্য প্রকাশ এবং সমর্থন জড়ো করতে বিকল্প প্রযুক্তিগত উপায়গুলো গ্রহণ করছে। এই নতুন ধারায়, বার্তা প্রেরণের আরো চতুর মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন মোবাইল টেক্সট মেসেজিং, পুস্তক এবং পামফ্লেট বিতরণ, যা যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।
বিক্ষোভকারীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যা কোনো কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে না। এটি বিক্ষোভ চলাকালে তথ্য আদান-প্রদানকে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবহারকারীরা এনক্রিপ্টেড চ্যাট অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে নিজেদের মতামত শেয়ার করছেন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন।
এছাড়া, প্রতিবাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে দূরবিন (Bluetooth) প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এটি একটি সাশ্রয়ী পন্থা, যা সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তুলনামূলকভাবে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর বিকল্প হিসেবে, মেসেজিং অ্যাপস যেমন টেলিগ্রাম ও সিগন্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে যা গোপনীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম।
তদুপরি, বিক্ষোভের নির্দেশিকা ও জনসমাবেশের সময়সূচি ঘন ঘন আপডেট করতে বিকল্প জনপ্রিয় সুবিধাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও, বিক্ষোভ পরিচালনা এবং সংগঠিত হওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন ব্যবহার আন্দোলনের গতিকে বৃদ্ধি করতে সহযোগিতা করছে, যেটি পারম্পরিক পন্থাগুলোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করছে।