আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিদ্যুৎ খাতে বিরাট দুর্নীতির অন্যতম প্রধান উৎস ছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা টেন্ডারে, প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়, এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে সরকার ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। এই দুর্নীতির মূলচক্রে ছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, পিডিবি চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিশেষত, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ছিলেন মূল হোতা, এবং সিন্ডিকেটের গডফাদার হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, এবং আহমেদ কায়কাউস। এই সিন্ডিকেট সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল—পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান ও খালেদ মাহমুদ চৌধুরী তাদের সহায়তা করেছেন।
তারা বিশেষ আইনে, বিনা দরপত্রে এবং প্রতিযোগিতা ছাড়াই ব্যবসায়ীদের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য।
বিদ্যুৎ খাতে বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে কয়লা ও ফার্নেস তেলসহ জ্বালানি আমদানির নামে বিপুল পরিমাণ টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবির ব্যয় ছিল ১.৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ সালের মধ্যে ৩.০৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
এই বিষয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি চুক্তিগুলোর পর্যালোচনা করছে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব মিলিয়ে তা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, পিডিবির তথ্য অনুসারে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৫০৭ কোটি টাকা, যা পরবর্তী বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৯০ কোটি টাকা হয়।
২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা পৌঁছায়, যদিও ওই সময় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার ছিল কম।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সামিটকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, যা ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা পেয়েছে।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস, যা ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা পেয়েছে। চতুর্থ স্থানে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপ, যা পেয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, আর পঞ্চম স্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) পেয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
বাংলা ক্যাট গ্রুপ ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা নিয়েছে। পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা মাত্র তিন বছর আগে উৎপাদন শুরু করেছে, পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ওরিয়ন গ্রুপ (৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা), খুলনা পাওয়ার কোম্পানি (কেপিসিএল) (৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা)। কেপিসিএলের ৩৫% শেয়ার সামিট এবং ৩৫% শেয়ার ইউনাইটেড গ্রুপের হাতে, ফলে খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশও তাদের কাছে গেছে।
দেশীয় অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে হোসাফ গ্রুপ পেয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, মোহাম্মদী গ্রুপ ২ হাজার ৫৪৪ কোটি, ডরিন গ্রুপ ২ হাজার ১৮৩ কোটি, এবং ম্যাক্স গ্রুপ পেয়েছে ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি এবং সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্পও যথাক্রমে ২ হাজার ৮৭ কোটি এবং ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা পেয়েছে।
আরও কিছু কোম্পানি যেমন—শাহজিবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্র (১ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা), সিকদার গ্রুপ (১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা), কনফিডেন্স গ্রুপ (১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা) এবং নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানি (১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা)—ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে।
শ্রীলঙ্কান কোম্পানি লক্ষধনভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে ১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, সিনহা গ্রুপকে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, এবং আনলিমা গ্রুপকে ১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গত ৯ বছরে প্রায় ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
২০১৩-১৪ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত এই চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে ছিল ৫০১ কোটি টাকা, তা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা।